Hi

০৮:১৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ২০ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ঠাকুরগাঁওয়ে দলিল লেখক সমিতির বিরুদ্ধে কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ

ঠাকুরগাঁও সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের দলিল লেখক সমিতির বিরুদ্ধে সমিতির নামে জমি ক্রেতা-বিক্রেতাদের জিম্মি করে বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তাদের এই চাঁদাবাজি ও হয়রানি বন্ধ করতে সাব-রেজিস্ট্রার অফিস থেকে কয়েকবার লিখিত পদক্ষেপ নেওয়া হলেও সমিতির নেতারা তা তোয়াক্কা করছেন না।


অবৈধ চাঁদা আদায় ও রাজনৈতিক প্রভাব

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু সাব-রেজিস্ট্রার অফিস নয়, স্বয়ং বাংলাদেশ নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক শহিদুল আলম ঝিনুক স্বাক্ষরিত পত্রে দেশের কোনো সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যেন দলিল লেখক সমিতির ব্যানারে দলিল প্রতি নির্দিষ্ট হারে অবৈধভাবে চাঁদা আদায় করা না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক ও নজরদারি রাখার জন্য সকল সাব-রেজিস্টার ও জেলার রেজিস্টারদের নির্দেশ প্রদান করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের দলিল লেখক সমিতির সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ সরকার, যিনি আওয়ামী লীগ সরকারের ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের আশীর্বাদপুষ্ট, তিনি বেপরোয়াভাবে সমিতির নামে চাঁদাবাজি শুরু করেছেন। তার কাছে জিম্মি সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় কয়েক বছর ধরে সমিতির সভাপতির চেয়ারটি দখল করে রয়েছেন তিনি।


ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ও সমিতির বক্তব্য

অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, জমি রেজিস্ট্রির ক্ষেত্রে নিয়মনীতি উপেক্ষা করে দলিল লেখক সমিতির বেপরোয়া চাঁদাবাজি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার পরিবর্তন হলেও দলিল লেখক সমিতির চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি এবং সাধারণ মানুষ তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে সমিতির নামে একটি নির্ধারিত হারে চাঁদা আদায় করা হয়। টাকা না দিলে কাজ হয় না, তাই বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করান।

সমিতির সদস্য কছির উদ্দিন স্বীকার করে বলেন, প্রতিদিন ৬০/৭০টি দলিল লেখা হয় এবং এর বিপরীতে সমিতির নামে দলিল প্রতি ৩০০ টাকা আদায় করা হয়, যা সংগঠনে জমা হয়। তিনি জানান, টাকা না পেলে দলিলের ফাইল ছাড়া হয় না এবং এটি এখানকার নিয়ম।

ঠাকুরগাঁও সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে সনদপ্রাপ্ত দলিল লেখক রয়েছেন ৮১ জন। নিয়ম অনুযায়ী দলিল লেখকদের প্রতি পৃষ্ঠা বাবদ ও সরকারি ফি’র হার নির্ধারণ করে তালিকা টানিয়ে রাখার নির্দেশনা থাকলেও, এসব নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না দলিল লেখক সমিতি।

দলিল করতে আসা আরিফুল ইসলাম, সমসের আলী ও আব্দুর রহিমসহ ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলেন, দুই শতক জমি রেজিস্ট্রি বাবদ সাড়ে তিন হাজার টাকা দিতে হয়েছে, যার মধ্যে দলিল লেখক সমিতি নিয়েছে ২ হাজার টাকা এবং অফিস খরচ বাবদ দেড় হাজার টাকা। তারা আরও জানান, কোনো কোনো ব্যক্তির কাছে চার থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে।

সদর উপজেলা ভুক্তভোগী হুমায়ুন কবির রেজা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমরা যদি কোনো দলিল রেজিস্ট্রি করতে আসি তখন দেখি দলিল লেখক সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বা তাদের মাধ্যমে যারা দলিল লিখে এরা বিভিন্নভাবে প্রতি দলিলে মানুষকে চরমভাবে হয়রানি করে।” তিনি আব্দুল ওয়াদুদ সরকারের বিরুদ্ধে মানুষকে জিম্মি করে চাঁদাবাজির অভিযোগ তোলেন এবং এর প্রতিকার দাবি করেন।

অভিযোগের বিষয়ে দলিল লেখক সমিতির সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরিচয় পেয়ে কথা না বলে ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে যান। তবে নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক জানান, সমিতির নামে চাঁদাবাজি নয়, তারা তাদের পারিশ্রমিক নিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, দলিল লেখার নির্দিষ্ট কোনো ফি নেই, অনেকেই খুশি হয়ে ৫/১০ হাজার টাকাও দেয়, আবার কেউ ২ হাজারও দেয়।


প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া

এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সদর সাব-রেজিস্ট্রার রেজাউল করিম জানান, সমিতির নামে জিম্মি করে দাতা বা গ্রহীতার কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, মানুষ যেন সরকারি ফিতে সেবা পায় সে বিষয়ে নজর রাখা হচ্ছে এবং অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হলে ঊর্ধ্বতনদের লিখিতভাবে জানানো হবে। তিনি আরও জানান, মাঝে মাঝে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং অভিযোগ থাকলে সমাধান করে দেন।

দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত ঠাকুরগাঁও জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আজমির শরিফ মারজী জানান, তাদের জানা মতে সমিতির নামে চাঁদা বা অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া যাবে না। যদি কেউ অভিযোগ করেন, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ট্যাগ :
লেখক সম্পর্কে তথ্য

ফ্রিডম ফ্লোটিলার সব নৌযান একসঙ্গে গাজার পথে এগোচ্ছে: শহিদুল আলম

ঠাকুরগাঁওয়ে দলিল লেখক সমিতির বিরুদ্ধে কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ

আপডেট : ০৯:৪৯:৩৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ মে ২০২৫

ঠাকুরগাঁও সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের দলিল লেখক সমিতির বিরুদ্ধে সমিতির নামে জমি ক্রেতা-বিক্রেতাদের জিম্মি করে বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তাদের এই চাঁদাবাজি ও হয়রানি বন্ধ করতে সাব-রেজিস্ট্রার অফিস থেকে কয়েকবার লিখিত পদক্ষেপ নেওয়া হলেও সমিতির নেতারা তা তোয়াক্কা করছেন না।


অবৈধ চাঁদা আদায় ও রাজনৈতিক প্রভাব

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু সাব-রেজিস্ট্রার অফিস নয়, স্বয়ং বাংলাদেশ নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক শহিদুল আলম ঝিনুক স্বাক্ষরিত পত্রে দেশের কোনো সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যেন দলিল লেখক সমিতির ব্যানারে দলিল প্রতি নির্দিষ্ট হারে অবৈধভাবে চাঁদা আদায় করা না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক ও নজরদারি রাখার জন্য সকল সাব-রেজিস্টার ও জেলার রেজিস্টারদের নির্দেশ প্রদান করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের দলিল লেখক সমিতির সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ সরকার, যিনি আওয়ামী লীগ সরকারের ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের আশীর্বাদপুষ্ট, তিনি বেপরোয়াভাবে সমিতির নামে চাঁদাবাজি শুরু করেছেন। তার কাছে জিম্মি সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় কয়েক বছর ধরে সমিতির সভাপতির চেয়ারটি দখল করে রয়েছেন তিনি।


ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ও সমিতির বক্তব্য

অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, জমি রেজিস্ট্রির ক্ষেত্রে নিয়মনীতি উপেক্ষা করে দলিল লেখক সমিতির বেপরোয়া চাঁদাবাজি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার পরিবর্তন হলেও দলিল লেখক সমিতির চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি এবং সাধারণ মানুষ তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে সমিতির নামে একটি নির্ধারিত হারে চাঁদা আদায় করা হয়। টাকা না দিলে কাজ হয় না, তাই বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করান।

সমিতির সদস্য কছির উদ্দিন স্বীকার করে বলেন, প্রতিদিন ৬০/৭০টি দলিল লেখা হয় এবং এর বিপরীতে সমিতির নামে দলিল প্রতি ৩০০ টাকা আদায় করা হয়, যা সংগঠনে জমা হয়। তিনি জানান, টাকা না পেলে দলিলের ফাইল ছাড়া হয় না এবং এটি এখানকার নিয়ম।

ঠাকুরগাঁও সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে সনদপ্রাপ্ত দলিল লেখক রয়েছেন ৮১ জন। নিয়ম অনুযায়ী দলিল লেখকদের প্রতি পৃষ্ঠা বাবদ ও সরকারি ফি’র হার নির্ধারণ করে তালিকা টানিয়ে রাখার নির্দেশনা থাকলেও, এসব নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না দলিল লেখক সমিতি।

দলিল করতে আসা আরিফুল ইসলাম, সমসের আলী ও আব্দুর রহিমসহ ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলেন, দুই শতক জমি রেজিস্ট্রি বাবদ সাড়ে তিন হাজার টাকা দিতে হয়েছে, যার মধ্যে দলিল লেখক সমিতি নিয়েছে ২ হাজার টাকা এবং অফিস খরচ বাবদ দেড় হাজার টাকা। তারা আরও জানান, কোনো কোনো ব্যক্তির কাছে চার থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে।

সদর উপজেলা ভুক্তভোগী হুমায়ুন কবির রেজা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমরা যদি কোনো দলিল রেজিস্ট্রি করতে আসি তখন দেখি দলিল লেখক সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বা তাদের মাধ্যমে যারা দলিল লিখে এরা বিভিন্নভাবে প্রতি দলিলে মানুষকে চরমভাবে হয়রানি করে।” তিনি আব্দুল ওয়াদুদ সরকারের বিরুদ্ধে মানুষকে জিম্মি করে চাঁদাবাজির অভিযোগ তোলেন এবং এর প্রতিকার দাবি করেন।

অভিযোগের বিষয়ে দলিল লেখক সমিতির সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরিচয় পেয়ে কথা না বলে ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে যান। তবে নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক জানান, সমিতির নামে চাঁদাবাজি নয়, তারা তাদের পারিশ্রমিক নিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, দলিল লেখার নির্দিষ্ট কোনো ফি নেই, অনেকেই খুশি হয়ে ৫/১০ হাজার টাকাও দেয়, আবার কেউ ২ হাজারও দেয়।


প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া

এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সদর সাব-রেজিস্ট্রার রেজাউল করিম জানান, সমিতির নামে জিম্মি করে দাতা বা গ্রহীতার কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, মানুষ যেন সরকারি ফিতে সেবা পায় সে বিষয়ে নজর রাখা হচ্ছে এবং অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হলে ঊর্ধ্বতনদের লিখিতভাবে জানানো হবে। তিনি আরও জানান, মাঝে মাঝে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং অভিযোগ থাকলে সমাধান করে দেন।

দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত ঠাকুরগাঁও জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আজমির শরিফ মারজী জানান, তাদের জানা মতে সমিতির নামে চাঁদা বা অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া যাবে না। যদি কেউ অভিযোগ করেন, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।