যশোরের মনিরামপুর উপজেলার কুয়াদা বাজারসংলগ্ন জামজামি, বাজুয়াডাঙ্গা, বাহিরমানিক, ভোজগাতি ও জালঝাড়া এই পাঁচটি গ্রাম এখন দেশের নার্সারি শিল্পের এক নতুন সম্ভাবনার নাম। এখানকার প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ সরাসরি নার্সারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রতি বছর এই অঞ্চল থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকার বিভিন্ন গাছের চারা বিক্রি হয়, যা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হচ্ছে। ফল, ফুল, ঔষধি ও কাঠজাতীয় বিভিন্ন প্রকার চারা উৎপাদনে এই গ্রামগুলো বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছে। নার্সারি মালিকরা মনে করছেন, সঠিক প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ এবং রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে এখানকার উৎপাদিত চারা বিদেশেও রপ্তানি করে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
জামজামি গ্রামের একজন সফল নার্সারি উদ্যোক্তা আফিল উদ্দীন জানান, ২০১৩ সালে তিনি পাশের বাজুয়াডাঙ্গা গ্রামের নার্সারি ব্যবসায়ী শাহাদত হোসেনের কাছ থেকে নার্সারি ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং এই পেশায় যুক্ত হন। শুরুতে চার বিঘা জমি লিজ নিয়ে নার্সারি শুরু করলেও বর্তমানে তার ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়েছে। তিনি জানান, প্রতি বছর প্রায় ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার চারা বিক্রি করে তার প্রায় তিন লাখ টাকা লাভ হয়। তার নার্সারিতে নিয়মিত আটজন শ্রমিক কাজ করেন এবং মৌসুমের সময় এই সংখ্যা বেড়ে ১২ জনে দাঁড়ায়।
আফিল উদ্দীনের নার্সারির পাশেই আব্দুল জব্বারের নার্সারি। তিনি জানান, গত ১২ বছর ধরে তিনি নার্সারি ব্যবসার সাথে যুক্ত। ৪২ কাঠা জমিতে তার নার্সারিতে নিয়মিত ছয়জন শ্রমিক কাজ করছেন। যদিও তারা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ পাননি, তবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে আধুনিক নার্সারি পদ্ধতি শিখে তারা উন্নত মানের চারা উৎপাদন করছেন।
জালঝাড়া গ্রামের আরেক সফল নার্সারি উদ্যোক্তা খালেদুর রহমান টিটো জানান, ১৯৮৪ সালে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) কুয়াদা এলাকার ৪০ জন আগ্রহী ব্যক্তিকে নার্সারি ব্যবসার উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করে। সেই সময় থেকেই এই লাভজনক ব্যবসা ধীরে ধীরে আশপাশের গ্রামগুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
কুয়াদা নার্সারি মালিক সমিতির সভাপতি রিপন হোসেন জানান, এই অঞ্চলের নার্সারিগুলো থেকে উৎপাদিত উন্নত মানের রেণু চারা যশোরের গদখালীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। বিশেষ করে গদখালীতে যে বিপুল পরিমাণে ফুলের চাষ হয়, তার চারার প্রধান উৎস এই কুয়াদার নার্সারিগুলো।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান বলেন, ‘এই পাঁচটি গ্রাম থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫০ কোটি টাকার চারা বিক্রি হয়। এই খাতকে যদি সঠিকভাবে উন্নয়ন করা যায়, তবে এটি দেশের অর্থনীতিতে একটি বড় অবদান রাখতে সক্ষম।’
মনিরামপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদা আক্তার জানান, বিদেশে চারা রপ্তানির জন্য আগ্রহী নার্সারি মালিকরা যশোর হর্টিকালচার সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে উন্নত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারেন।
যশোর হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক দীপঙ্কর দাশ বলেন, নার্সারি মালিকদের প্রশিক্ষণের জন্য বর্তমানে নির্দিষ্ট কোনো সরকারি প্রকল্প না থাকলেও, চলতি বছর সীমিত পরিসরে কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সরকারি সহযোগিতা পাওয়া গেলে রপ্তানিযোগ্য চারা উৎপাদনে আরও ব্যাপক প্রশিক্ষণ প্রদান করা সম্ভব।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মিজানুর রহমান খান বলেন, নার্সারি মালিকরা যদি উদ্যোগী হন, তবে তিনি কৃষি বিভাগ, সাংবাদিক এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের নিয়ে একটি বৈঠকের আয়োজন করতে পারেন। সেখানে নার্সারি ব্যবসায়ীদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তার সমাধানের সূত্র বের করা হবে এবং দ্রুত সমাধানের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো হবে। এই পাঁচটি গ্রামের মানুষের অক্লান্ত শ্রম, প্রবল আগ্রহ ও উদ্ভাবনী শক্তি যদি যথাযথ সরকারি সহায়তা পায়, তবে যশোরের কুয়াদা অচিরেই দেশের অন্যতম প্রধান চারা রপ্তানিকারক অঞ্চলে পরিণত হতে পারে।