জুলাই মাসে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা মামলায়, পুলিশের একজন উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. আশরাফুল ইসলাম, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রপক্ষের ৩৯তম সাক্ষী হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) এই জবানবন্দি পেশ করেন।
আশরাফুল ইসলামের জবানবন্দিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কীভাবে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে। বিশেষ করে, রাজধানীর চাঁনখারপুল এলাকায় আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলপ্রয়োগের নানা নমুনা তিনি তুলে ধরেন।
জবানবন্দির মূল বিষয়বস্তু:
- নির্দেশনার প্রেক্ষাপট: এসআই আশরাফুল জানান, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট চাঁনখারপুল এলাকায় তিনিসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) শাহ আলম মো. আক্তারুল ইসলামের নির্দেশে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি ছোড়েন। যখন অধস্তন পুলিশ কর্মকর্তারা গুলি করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, তখন এডিসি আক্তারুল ইসলাম তাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং চাকরিচ্যুতির হুমকি দেন।
- পুলিশি নিয়োগ ও কর্মস্থল: ১৯৯৪ সালের ১১ জানুয়ারি পুলিশে যোগ দেওয়া আশরাফুল ইসলাম ২০০২ সালের ১৩ জুলাই থেকে ডিএমপিতে কর্মরত আছেন এবং ২০১৮ সালে এসআই (সশস্ত্র) হিসেবে পদোন্নতি পান।
- আন্দোলন দমনে পুলিশের ভূমিকা: গত বছরের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে তিনি পুলিশ লাইন মিরপুর থেকে রওনা হয়ে শাহবাগ থানায় আইনশৃঙ্খলা ডিউটির জন্য যান। সেখানে তিনি জানতে পারেন যে, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং যুগ্ম পুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী আন্দোলন দমনের জন্য গুলি চালানোর নির্দেশনা দিয়ে গেছেন।
- মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ও পুলিশের অবস্থান: ওই দিন আন্দোলনকারীদের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ছিল। সকাল ৯টার দিকে মোট পাঁচ প্লাটুন পুলিশ, রমনা জোনের তৎকালীন এসি ইমরুল এবং শাহবাগ থানার ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) মো. আরশাদ হোসেনকে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা ডিউটি নিয়ে ব্রিফ করেন এডিসি আক্তারুল ইসলাম। ব্রিফিং শেষে ৬০/৬৫ জন পুলিশ সদস্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ডিউটিতে যান, যার মধ্যে এসআই আশরাফুলও ছিলেন।
- চাঁনখারপুলে গুলি বর্ষণ: শহীদ মিনার এলাকায় সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের পর আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে এডিসি আক্তারুলের নির্দেশে কয়েকজন আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করে শাহবাগ থানায় নেওয়া হয়। এরপর এডিসি আক্তারুলের নির্দেশে এসআই আশরাফুল, এসি ইমরুল, ইন্সপেক্টর আরশাদ এবং আনুমানিক ১৫/২০ জন এপিবিএন সদস্য ও ডিএমপির ১০/১৫ জন সদস্য চাঁনখারপুলে যান। সেখানে চাঁনখারপুল সংলগ্ন বংশাল ও চকবাজার এলাকা থেকে আসা ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলি করা হয়।
- অপ্রয়োজনীয় ও অবৈধ আদেশ: এসআই আশরাফুল উল্লেখ করেন যে, এডিসি আক্তারুল ইসলাম বলেছিলেন, “তোমাদের যাদের কাছে পিস্তল ও চায়না রাইফেল আছে তারা আন্দোলনকারীদের দিকে ফায়ার করে তাদের মেরে ফেলো।” এই আদেশ পালনে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হয়।
- গুলি বর্ষণের ঘটনা: কনস্টেবল সুজন হোসেন এবং এপিবিএনের কনস্টেবল ইমাজ হোসেন ইমন আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করেন।
- পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ হারানো: বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে গেলে এবং শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে চানখারপুল এলাকার পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
- অস্ত্র জমা দান ও অতিরিক্ত গুলি: এডিসি আক্তারুলের নির্দেশে অস্ত্রগুলো শাহবাগ থানার অস্ত্রাগারে জমা দেওয়ার সময় কনস্টেবল নাসিরুল ইসলাম জানান যে, এডিসি আক্তারুল তাকে অতিরিক্ত গুলি সরবরাহ করেছিলেন।
- আত্মগোপন: এরপর এসআই আশরাফুল সিভিল পোশাকে শাহবাগ থানার পিছন দিয়ে বের হয়ে পায়ে হেঁটে ছাত্র-জনতার সঙ্গে মিশে মিরপুর পুলিশ লাইনে পৌঁছান।