Hi

০৭:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ২০ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জিলহজ মাসের ফজিলত ও ইবাদত

জিলহজ, আরবি বার মাসের শেষ এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ মাস। বছরের চারটি নিষিদ্ধ মাসের মধ্যে জিলহজ অন্যতম (অন্যগুলো হলো মুহাররম, রজব ও জিলকদ), যেখানে কোনো প্রকার যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ। রাসূল (সা.)-এর জন্মের পূর্বেও জাহেলিয়াতের যুগে এই মাসগুলোকে নিষিদ্ধ মানা হতো, যদিও কিছু ক্ষেত্রে গোষ্ঠী প্রধানদের ইচ্ছানুযায়ী পরিবর্তন আনা হতো। নবুওত প্রাপ্তির পর আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত রাসূল (সা.) এই মাসগুলোকে আলাদা গুরুত্ব ও মর্যাদা দিয়ে মহিমান্বিত করেন। এই মাসেই স্বচ্ছল মুসলিম উম্মাহ হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা ও মদিনায় যান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নৈকট্য লাভের আশায়।

জিলহজের প্রথম দশ দিনের গুরুত্ব:

যদিও পুরো জিলহজ মাসই গুরুত্বপূর্ণ, তবে এর প্রথম দশ দিনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

  • আট তারিখ (ইউমে তারবিয়া): এই দিনে ইবরাহিম (আ.) প্রথম স্বপ্নে তার পুত্র সন্তানকে কোরবানি দেওয়ার নির্দেশ পান এবং তিনি সন্দেহে পড়েন যে এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে না শয়তানের।
  • নয় তারিখ (ইউমে আরাফা): এই দিনে তিনি আবার একই স্বপ্ন দেখে বুঝতে পারেন যে এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে। হাজিদের জন্য এদিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আরাফায় অবস্থান (উকুফ) করা হজের একটি ফরজ বিধান। হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ এই দিনে যত গুনাহগারকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, তত জনকে আর কোনো দিন দেন না। এদিনেই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা ঘোষণা করেছেন: “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি, আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি সম্পূর্ণ করেছি এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছি।”
  • দশ তারিখ (ইউমে নাহার/কোরবানির দিন): এদিন হযরত ইবরাহিম (আ.) তার পুত্রকে কোরবানি করার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন এবং আল্লাহর সামনে পেশ করেছিলেন। এদিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল হচ্ছে কোরবানি করা।

কোরআনের কসম ও ফজিলত:

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের সুরা ফজর এর শুরুতে কসম করে বলেছেন: “১) ফজরের কসম, ২) দশটি রাতের,” হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ফজরের নামাজ, আর অপরটির দ্বারা উদ্দেশ্য হলো জিলহজ মাসের প্রথম দশ রাত্রি। তবে অধিকাংশ মুফাসসিরিনে কেরামের মতে, এই দুটি দ্বারাই উদ্দেশ্য হচ্ছে জিলহজ মাসের প্রথম দশ রাত্রি, যা দ্বারা আল্লাহ এই দশ দিনের গুরুত্ব বুঝাতে চেয়েছেন।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব:

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) জিলহজ মাসের প্রথম দশ তারিখের আরও কিছু ফজিলত বর্ণনা করেছেন:

  • হযরত আদম (আ.)-কে জিলহজ মাসের নয় তারিখে আরাফায় থাকাকালীন ক্ষমা করা হয়েছিল।
  • আল্লাহ হযরত ইবরাহিম (আ.)-কে এ মাসের দশ তারিখে তার খলিল (ঘনিষ্ঠ বন্ধু) রূপে মনোনীত করেন, তার পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি রূপে পেশ করার জন্য।
  • এ মাসের প্রথম দশকেই হযরত ইবরাহিম (আ.) কাবা শরিফের ভিত্তিস্থাপন করেছেন।
  • এ দশকেই হযরত মূসা (আ.) আল্লাহর সঙ্গে কালাম (কথা) করেছেন।
  • বায়াতে রিযওয়ানও এ মাসের প্রথম দশকেই হয়েছে।

এ দশকের বিশেষ আমল:

  • হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি জিলহজ মাসের প্রথম দশকের প্রত্যেক রাত্রি ইবাদতে কাটালো, সে যেন সারা বছর হজ ও উমরাহ করে কাটালো। আর যে ব্যক্তি এ দশকে রোজা রাখলো, সে যেন সারা বছরই রোজা রাখলো (মুকাশিফাতুল কুলুব)।
  • হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জিলহজ মাসের প্রথম দশকের ইবাদতই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি পছন্দ। এ দশকের প্রত্যেক দিনের রোজা এক বছরের সমপরিমাণ সওয়াব এবং প্রত্যেক রাত্রের ইবাদত শবে কদরের সমপরিমাণ (মেশকাত)।
  • অন্য একটি হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি জিলহজ মাসের নবম তারিখে রোজা রাখবে, আল্লাহ তায়ালা বিগত এক বছরের ও আগত বছরের সমপরিমাণ গুনাহ মাফ করে দিবেন (মুসলিম)। তবে হজ পালনকারীদের জন্য নবম তারিখের রোজা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে, কারণ এতে ইবাদতে বিঘ্ন ঘটতে পারে (আবু দাউদ)।
  • দশ তারিখের ইবাদত হচ্ছে কোরবানি করা, এবং এদিন এটাই সর্বোত্তম ইবাদত। কোরবানি করা পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। তাই বিশুদ্ধ নিয়তে কোরবানি করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, যাদের কোরবানি করার সামর্থ্য আছে অথচ কোরবানি করছে না, তারা যেন ঈদগাহে না আসে।

সুতরাং, আল্লাহ আমাদের যাকে যতটুক তওফিক দিয়েছেন, সে অনুযায়ী আমরা যেন এই মাস সম্পর্কে জেনে, বুঝে আমল করতে পারি। মহান আল্লাহ পাক আমাদেরকে আমল করার তওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।

লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক ও কলামিস্ট হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী ছাহেব। সাবেক: ইমাম ও খতিব কদমতলী মাজার জামে মসজিদ সিলেট।

ট্যাগ :
লেখক সম্পর্কে তথ্য

ফ্রিডম ফ্লোটিলার সব নৌযান একসঙ্গে গাজার পথে এগোচ্ছে: শহিদুল আলম

জিলহজ মাসের ফজিলত ও ইবাদত

আপডেট : ১০:৪০:৫০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫

জিলহজ, আরবি বার মাসের শেষ এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ মাস। বছরের চারটি নিষিদ্ধ মাসের মধ্যে জিলহজ অন্যতম (অন্যগুলো হলো মুহাররম, রজব ও জিলকদ), যেখানে কোনো প্রকার যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ। রাসূল (সা.)-এর জন্মের পূর্বেও জাহেলিয়াতের যুগে এই মাসগুলোকে নিষিদ্ধ মানা হতো, যদিও কিছু ক্ষেত্রে গোষ্ঠী প্রধানদের ইচ্ছানুযায়ী পরিবর্তন আনা হতো। নবুওত প্রাপ্তির পর আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত রাসূল (সা.) এই মাসগুলোকে আলাদা গুরুত্ব ও মর্যাদা দিয়ে মহিমান্বিত করেন। এই মাসেই স্বচ্ছল মুসলিম উম্মাহ হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা ও মদিনায় যান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নৈকট্য লাভের আশায়।

জিলহজের প্রথম দশ দিনের গুরুত্ব:

যদিও পুরো জিলহজ মাসই গুরুত্বপূর্ণ, তবে এর প্রথম দশ দিনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

  • আট তারিখ (ইউমে তারবিয়া): এই দিনে ইবরাহিম (আ.) প্রথম স্বপ্নে তার পুত্র সন্তানকে কোরবানি দেওয়ার নির্দেশ পান এবং তিনি সন্দেহে পড়েন যে এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে না শয়তানের।
  • নয় তারিখ (ইউমে আরাফা): এই দিনে তিনি আবার একই স্বপ্ন দেখে বুঝতে পারেন যে এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে। হাজিদের জন্য এদিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আরাফায় অবস্থান (উকুফ) করা হজের একটি ফরজ বিধান। হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ এই দিনে যত গুনাহগারকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, তত জনকে আর কোনো দিন দেন না। এদিনেই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা ঘোষণা করেছেন: “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি, আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি সম্পূর্ণ করেছি এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছি।”
  • দশ তারিখ (ইউমে নাহার/কোরবানির দিন): এদিন হযরত ইবরাহিম (আ.) তার পুত্রকে কোরবানি করার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন এবং আল্লাহর সামনে পেশ করেছিলেন। এদিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল হচ্ছে কোরবানি করা।

কোরআনের কসম ও ফজিলত:

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের সুরা ফজর এর শুরুতে কসম করে বলেছেন: “১) ফজরের কসম, ২) দশটি রাতের,” হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ফজরের নামাজ, আর অপরটির দ্বারা উদ্দেশ্য হলো জিলহজ মাসের প্রথম দশ রাত্রি। তবে অধিকাংশ মুফাসসিরিনে কেরামের মতে, এই দুটি দ্বারাই উদ্দেশ্য হচ্ছে জিলহজ মাসের প্রথম দশ রাত্রি, যা দ্বারা আল্লাহ এই দশ দিনের গুরুত্ব বুঝাতে চেয়েছেন।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব:

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) জিলহজ মাসের প্রথম দশ তারিখের আরও কিছু ফজিলত বর্ণনা করেছেন:

  • হযরত আদম (আ.)-কে জিলহজ মাসের নয় তারিখে আরাফায় থাকাকালীন ক্ষমা করা হয়েছিল।
  • আল্লাহ হযরত ইবরাহিম (আ.)-কে এ মাসের দশ তারিখে তার খলিল (ঘনিষ্ঠ বন্ধু) রূপে মনোনীত করেন, তার পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি রূপে পেশ করার জন্য।
  • এ মাসের প্রথম দশকেই হযরত ইবরাহিম (আ.) কাবা শরিফের ভিত্তিস্থাপন করেছেন।
  • এ দশকেই হযরত মূসা (আ.) আল্লাহর সঙ্গে কালাম (কথা) করেছেন।
  • বায়াতে রিযওয়ানও এ মাসের প্রথম দশকেই হয়েছে।

এ দশকের বিশেষ আমল:

  • হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি জিলহজ মাসের প্রথম দশকের প্রত্যেক রাত্রি ইবাদতে কাটালো, সে যেন সারা বছর হজ ও উমরাহ করে কাটালো। আর যে ব্যক্তি এ দশকে রোজা রাখলো, সে যেন সারা বছরই রোজা রাখলো (মুকাশিফাতুল কুলুব)।
  • হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জিলহজ মাসের প্রথম দশকের ইবাদতই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি পছন্দ। এ দশকের প্রত্যেক দিনের রোজা এক বছরের সমপরিমাণ সওয়াব এবং প্রত্যেক রাত্রের ইবাদত শবে কদরের সমপরিমাণ (মেশকাত)।
  • অন্য একটি হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি জিলহজ মাসের নবম তারিখে রোজা রাখবে, আল্লাহ তায়ালা বিগত এক বছরের ও আগত বছরের সমপরিমাণ গুনাহ মাফ করে দিবেন (মুসলিম)। তবে হজ পালনকারীদের জন্য নবম তারিখের রোজা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে, কারণ এতে ইবাদতে বিঘ্ন ঘটতে পারে (আবু দাউদ)।
  • দশ তারিখের ইবাদত হচ্ছে কোরবানি করা, এবং এদিন এটাই সর্বোত্তম ইবাদত। কোরবানি করা পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। তাই বিশুদ্ধ নিয়তে কোরবানি করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, যাদের কোরবানি করার সামর্থ্য আছে অথচ কোরবানি করছে না, তারা যেন ঈদগাহে না আসে।

সুতরাং, আল্লাহ আমাদের যাকে যতটুক তওফিক দিয়েছেন, সে অনুযায়ী আমরা যেন এই মাস সম্পর্কে জেনে, বুঝে আমল করতে পারি। মহান আল্লাহ পাক আমাদেরকে আমল করার তওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।

লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক ও কলামিস্ট হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী ছাহেব। সাবেক: ইমাম ও খতিব কদমতলী মাজার জামে মসজিদ সিলেট।