Hi

০১:৩৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ২১ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সাঁকো নয়, সেতু চাই! সাভার আশুলিয়ায় ৪০ হাজার মানুষের জীবন-মরণ লড়াই!

  • আপডেট : ০৮:৫৮:০৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫
  • ৬২০ জন দেখেছে

আশুলিয়া, বাংলাদেশ: আধুনিকতার ছোঁয়া যেখানে শহরকে করেছে ঝলমলে, সেখানে সাভার আশুলিয়ার ধামসোনা ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ আজও আদিম জীবনযাপন করছেন। তাদের একমাত্র ভরসা—হাতে তৈরি নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো! উনাইন, গোয়ালটেক, গাছটেক, গোপালবাড়ি, এবং গৌরপাড়া—এই গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের কাছে বংশী নদী পারাপার মানেই যেন প্রতিদিন এক নতুন যুদ্ধ, এক সীমাহীন দুর্ভোগ।

 

৪০ হাজার মানুষের জীবনরেখা: এক নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো!

বছরের পর বছর ধরে এই পাঁচ গ্রামের সঙ্গে সাভারের মূল শহরের একমাত্র সংযোগ বংশী নদী। কিন্তু এখানে কোনো স্থায়ী সেতু নেই। আছে কেবল গ্রামবাসীর নিজেদের উদ্যোগে তৈরি করা তিনটি বাঁশের সাঁকো। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বাজার, কর্মস্থলে যাওয়ার একমাত্র অবলম্বন এই সাঁকো। ঝড়, বর্ষা বা খরার দিন—প্রতিদিনই এই সাঁকো পারাপার এক বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা।

বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে যখন নদী ফুঁসে ওঠে, তখন সাঁকো ভেঙে পড়ে। সেই সময় একমাত্র ভরসা হয় নৌকা আর ট্রলার, যা মোটেও নিরাপদ নয়। যদিও নৌ-দুর্ঘটনার তেমন কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই, কিন্তু স্থানীয়দের চোখে দেখা কান্নার অনেক গল্প আছে। এই নদী কেড়ে নিয়েছে অনেক প্রাণ, থামিয়ে দিয়েছে অনেক স্বপ্ন!

 

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য: জীবন বাজি রেখে নদী পারাপার!

এই অঞ্চলে মাত্র একটি প্রাইমারি স্কুল, একটি কলেজ এবং দুটি মাদ্রাসা আছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষা বা জরুরি চিকিৎসার জন্য পাড়ি দিতে হয় নদীর ওপারে। গ্রামের ভেতরে কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র তো দূরের কথা, অনেক জায়গায় একটি ওষুধের দোকানও নেই! রোগী, প্রসূতি মা বা জরুরি সেবার প্রয়োজন হলে জীবন বাজি রেখে নদী পার হতে হয়।

বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের রিপোর্ট অনুযায়ী, শহুরে এলাকায় যেখানে ৬৭% স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার পাওয়া যায়, সেখানে গ্রামীণ এলাকায় এই হার মাত্র ২৫%। এই যোগাযোগের কষ্ট এই গ্রামের মানুষগুলোর জন্য স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সেবা পাওয়াকে আরও কঠিন করে তুলেছে।

শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, নারী-পুরুষ শ্রমিক এবং শিক্ষকেরাও প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো পার হন। পায়ে হেঁটে পারাপারের পাশাপাশি এই সাঁকো দিয়ে মোটরসাইকেল ও অটোরিকশার মতো যানবাহনও চলাচল করে, যা যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। একটি সেতু নির্মাণ হলে শুধু যাতায়াতের সীমাহীন কষ্টই দূর হবে না, বরং এই এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাইলফলক হয়ে উঠবে।

 

দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতি, অধরা স্বপ্ন: জনপ্রতিনিধিদের নীরবতা!

গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, স্বাধীনতার পর থেকেই তারা একটি স্থায়ী সেতুর স্বপ্ন দেখে আসছেন। বহুবার জনপ্রতিনিধিরা আশ্বাস দিয়েছেন, প্রকল্পের কাগজে-কলমে নামও উঠেছে, কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম কেটে গেলেও বাঁশের সাঁকোই তাদের নিয়তি হয়ে আছে। বিগত সরকারগুলোর সময়েও বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। কার্তিক মাস থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত এই আট মাস ধরে নদীর ওপর বাঁশের সাঁকো দিয়েই চরম ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছেন এই এলাকার মানুষ।

বর্তমানে যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের পর ছাড়া এই কাজ সম্ভব নয়, কারণ বাজেট লাগবে।

 

জনস্বার্থ দেখানোর নামে অর্থ অপচয়: অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ!

আশুলিয়ায় স্থানীয়দের সেতু নির্মাণের দাবি যেমন পুরোনো, তেমনি তা অগ্রাহ্য করে অপ্রয়োজনীয় স্থানে সেতু নির্মাণ করে অর্থ অপচয়ের ঘটনাও পুরাতন। প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি সঠিকভাবে না করা, গুণগতমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার না করা ও নির্মাণে দীর্ঘসূত্রিতাসহ বিভিন্ন কারণে ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় খরচ এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়।

৪০ হাজার মানুষের এই সীমাহীন দুর্ভোগ কবে শেষ হবে, সেই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সাভার আশুলিয়ার বাতাসে। একটি স্থায়ী সেতুর স্বপ্ন কবে বাস্তব হবে, সেই অপেক্ষায় দিন গুনছে এই পাঁচ গ্রামের মানুষ।

ট্যাগ :
লেখক সম্পর্কে তথ্য

জনপ্রিয়

ঝিনাইদহে  হুলস্থুল! আ.লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের ‘বিগ শট’ নেতারা হাজতে! পুরনো ‘ভাঙচুর’ মামলায় কাঁপছে রাজনীতি! 

সাঁকো নয়, সেতু চাই! সাভার আশুলিয়ায় ৪০ হাজার মানুষের জীবন-মরণ লড়াই!

আপডেট : ০৮:৫৮:০৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫

আশুলিয়া, বাংলাদেশ: আধুনিকতার ছোঁয়া যেখানে শহরকে করেছে ঝলমলে, সেখানে সাভার আশুলিয়ার ধামসোনা ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ আজও আদিম জীবনযাপন করছেন। তাদের একমাত্র ভরসা—হাতে তৈরি নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো! উনাইন, গোয়ালটেক, গাছটেক, গোপালবাড়ি, এবং গৌরপাড়া—এই গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের কাছে বংশী নদী পারাপার মানেই যেন প্রতিদিন এক নতুন যুদ্ধ, এক সীমাহীন দুর্ভোগ।

 

৪০ হাজার মানুষের জীবনরেখা: এক নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো!

বছরের পর বছর ধরে এই পাঁচ গ্রামের সঙ্গে সাভারের মূল শহরের একমাত্র সংযোগ বংশী নদী। কিন্তু এখানে কোনো স্থায়ী সেতু নেই। আছে কেবল গ্রামবাসীর নিজেদের উদ্যোগে তৈরি করা তিনটি বাঁশের সাঁকো। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বাজার, কর্মস্থলে যাওয়ার একমাত্র অবলম্বন এই সাঁকো। ঝড়, বর্ষা বা খরার দিন—প্রতিদিনই এই সাঁকো পারাপার এক বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা।

বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে যখন নদী ফুঁসে ওঠে, তখন সাঁকো ভেঙে পড়ে। সেই সময় একমাত্র ভরসা হয় নৌকা আর ট্রলার, যা মোটেও নিরাপদ নয়। যদিও নৌ-দুর্ঘটনার তেমন কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই, কিন্তু স্থানীয়দের চোখে দেখা কান্নার অনেক গল্প আছে। এই নদী কেড়ে নিয়েছে অনেক প্রাণ, থামিয়ে দিয়েছে অনেক স্বপ্ন!

 

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য: জীবন বাজি রেখে নদী পারাপার!

এই অঞ্চলে মাত্র একটি প্রাইমারি স্কুল, একটি কলেজ এবং দুটি মাদ্রাসা আছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষা বা জরুরি চিকিৎসার জন্য পাড়ি দিতে হয় নদীর ওপারে। গ্রামের ভেতরে কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র তো দূরের কথা, অনেক জায়গায় একটি ওষুধের দোকানও নেই! রোগী, প্রসূতি মা বা জরুরি সেবার প্রয়োজন হলে জীবন বাজি রেখে নদী পার হতে হয়।

বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের রিপোর্ট অনুযায়ী, শহুরে এলাকায় যেখানে ৬৭% স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার পাওয়া যায়, সেখানে গ্রামীণ এলাকায় এই হার মাত্র ২৫%। এই যোগাযোগের কষ্ট এই গ্রামের মানুষগুলোর জন্য স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সেবা পাওয়াকে আরও কঠিন করে তুলেছে।

শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, নারী-পুরুষ শ্রমিক এবং শিক্ষকেরাও প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো পার হন। পায়ে হেঁটে পারাপারের পাশাপাশি এই সাঁকো দিয়ে মোটরসাইকেল ও অটোরিকশার মতো যানবাহনও চলাচল করে, যা যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। একটি সেতু নির্মাণ হলে শুধু যাতায়াতের সীমাহীন কষ্টই দূর হবে না, বরং এই এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাইলফলক হয়ে উঠবে।

 

দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতি, অধরা স্বপ্ন: জনপ্রতিনিধিদের নীরবতা!

গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, স্বাধীনতার পর থেকেই তারা একটি স্থায়ী সেতুর স্বপ্ন দেখে আসছেন। বহুবার জনপ্রতিনিধিরা আশ্বাস দিয়েছেন, প্রকল্পের কাগজে-কলমে নামও উঠেছে, কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম কেটে গেলেও বাঁশের সাঁকোই তাদের নিয়তি হয়ে আছে। বিগত সরকারগুলোর সময়েও বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। কার্তিক মাস থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত এই আট মাস ধরে নদীর ওপর বাঁশের সাঁকো দিয়েই চরম ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছেন এই এলাকার মানুষ।

বর্তমানে যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের পর ছাড়া এই কাজ সম্ভব নয়, কারণ বাজেট লাগবে।

 

জনস্বার্থ দেখানোর নামে অর্থ অপচয়: অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ!

আশুলিয়ায় স্থানীয়দের সেতু নির্মাণের দাবি যেমন পুরোনো, তেমনি তা অগ্রাহ্য করে অপ্রয়োজনীয় স্থানে সেতু নির্মাণ করে অর্থ অপচয়ের ঘটনাও পুরাতন। প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি সঠিকভাবে না করা, গুণগতমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার না করা ও নির্মাণে দীর্ঘসূত্রিতাসহ বিভিন্ন কারণে ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় খরচ এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়।

৪০ হাজার মানুষের এই সীমাহীন দুর্ভোগ কবে শেষ হবে, সেই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সাভার আশুলিয়ার বাতাসে। একটি স্থায়ী সেতুর স্বপ্ন কবে বাস্তব হবে, সেই অপেক্ষায় দিন গুনছে এই পাঁচ গ্রামের মানুষ।