আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ২১ জুন ২০২৫: ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতে পুরো মধ্যপ্রাচ্য উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতির জেরে ইসরায়েলে অবস্থানরত হাজার হাজার ভারতীয় নাগরিক চরম দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন। অনেকে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেও, বর্তমান নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে তা কবে সম্ভব হবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
তেল আবিবে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিক রাঘবেন্দ্র নাইক, যিনি পেশায় একজন কেয়ারগিভার এবং গত ১৩ বছর ধরে ইসরায়েলে রয়েছেন, তিনি জানান, “আমার ছয় বছরের মেয়েটাকে বহুদিন দেখিনি। ভেবেছিলাম সামনের মাসে বাড়ি যাব। কিন্তু ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে গেল। কবে যেতে পারব জানি না।” তার মতোই একই রকম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন আরও অনেক ভারতীয়। তাদের কাছে প্রতিটি রাত এখন একেকটি যুদ্ধের প্রস্তুতি, কারণ সাইরেন বাজলেই তাদের ছুটতে হয় বোমা হামলা থেকে বাঁচার জন্য ভূগর্ভস্থ শেল্টারে।
তেলেঙ্গানা অ্যাসোসিয়েশন অব ইসরায়েলের সভাপতি সোমা রভিও একই রকম উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “গত সপ্তাহে আমার মেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে এসেছে। ওর সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন সব পরিকল্পনা অনিশ্চিত।”
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে আনুমানিক ১৮,০০০ থেকে ২০,০০০ ভারতীয় কর্মী ইসরায়েলে অবস্থান করছেন। তবে বেসরকারিভাবে এই সংখ্যা আরও বেশি বলেই মনে করা হয়। শুধু ২০২৫ সালের ১০ মার্চ পর্যন্তই ৬,৬৯৪ জন ভারতীয় নাগরিক ইসরায়েলে বৈধভাবে প্রবেশ করেছেন বলে সরকারি তথ্য বলছে।
বর্তমানে প্রায় ১৯৫টি ইসরায়েলি কোম্পানিতে ভারতীয়রা নিযুক্ত আছেন। তারা মূলত দুটি খাতে কাজ করেন—স্বাস্থ্যসেবা ও নির্মাণ খাত। ইন্ডিয়ান ইকোনমিক ট্রেড অর্গানাইজেশনের প্রেসিডেন্ট ড. আসিফ ইকবালের মতে, ভারতীয়দের সবচেয়ে বেশি চাহিদা কেয়ারগিভার বা নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। প্রবীণ ইসরায়েলিদের দেখভাল করার জন্য ভারতীয়রা কার্যত অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন। এরা মূলত দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী, যাদের অধিকাংশই দক্ষিণ ভারত থেকে আসেন। নির্মাণ খাতেও ভারতীয়দের চাহিদা বাড়ছে। ভবন নির্মাণ, প্লাস্টারিং, রড বাঁকানোসহ বিভিন্ন নির্মাণ কাজে অনেক ভারতীয় বর্তমানে নিযুক্ত রয়েছেন।
ম্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা পিএন লরেন্স বলেন, “ইসরায়েলে বেতন ভালো, স্বাস্থ্যবিমা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত। যুদ্ধের ভয় থাকলেও এখানকার সরকারি সুযোগ-সুবিধা অন্য দেশের তুলনায় বেশি। আমাদের উপার্জনের উপর ভারতে থাকা পরিবার নির্ভর করে।”
ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনার জেরে ইতোমধ্যেই ভারত সরকার সম্ভাব্য উদ্ধারের প্রস্তুতি শুরু করেছে। ইসরায়েল থেকে ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনতে প্রথমে তাদের স্থলপথে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছে। পরে সেখান থেকে বিশেষ বিমানে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। তেল আবিবে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস পুরো বিষয়টি তদারকি করছে।
ইসরায়েলে থাকা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের জীবনও এই সংঘাতে পাল্টে যাচ্ছে। দেশটির সামরিক নিয়ম অনুযায়ী, মেয়েদেরও বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়। এমনই একজন তরুণী স্তাভ, যিনি দুই বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে দায়িত্ব শেষ করে ফিরেছেন, জানাচ্ছেন—”আমাকে হয়তো আবার সেনাবাহিনীতে যেতে হতে পারে।”
একদিকে ভালো বেতন ও সুযোগের দেশ ইসরায়েল, অন্যদিকে ক্ষেপণাস্ত্র ও সাইরেনের আতঙ্ক। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছেন হাজার হাজার ভারতীয় কর্মী। রাঘবেন্দ্র নাইকের কণ্ঠেই যেন উঠে আসে সবার মনোভাব—”আগে বছরে অন্তত একবার দেশে যেতে পারতাম। এখন তো সবই অনিশ্চিত। এখন শুধু ভয় হয়—ফিরতে পারব তো?”