Hi

০৫:২৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পাঁচবিবিতে হাঁস পালনে স্বাবলম্বী মিনারা বেগম: সফলতার নতুন দিশা!

জয়পুরহাট, ২৪ জুন ২০২৫: এক সময়ের অভাবী সংসারের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে নিজের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছেন পাঁচবিবি উপজেলার আওলাই ইউনিয়নের নওগাঁ কাঁঠালী গ্রামের গৃহিণী মিনারা বেগম। তিনি এখন একজন সফল উদ্যোক্তা, যিনি হাঁস পালন করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। তার এই প্রচেষ্টা দেখে এলাকার অনেকেই এখন বাড়তি আয়ের আশায় হাঁস পালনের কথা ভাবছেন।


অভাব থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প

মিনারা বেগমের স্বামী ফজলুর রহমান একজন প্রান্তিক কৃষক, যার জমিজমা খুব বেশি নয়। দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে তারা অত্যন্ত কষ্টে দিন কাটাচ্ছিলেন। সামান্য জমি চাষাবাদ আর কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে ইতোমধ্যে বড় মেয়ে ও ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে কওমী মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। ছেলেমেয়েদের বিয়ে ও ছোট মেয়ের পড়াশোনার খরচ যোগাতে গিয়ে তারা অনেকটাই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সংসারের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনৈতিকভাবে চরম সংকটে পড়ে যান মিনারা ও ফজলুর দম্পতি।

স্বামীর আয়ে সংসার চালানো দায় হয়ে পড়লে মিনারা বেগম আয় বাড়াতে বিকল্প চিন্তা করেন। সেই ভাবনা থেকে গত পাঁচ বছর আগে পার্শ্ববর্তী ঘোড়াঘাট উপজেলার বলাহার গ্রামের তার ভাইয়ের হাঁসের খামার দেখে হাঁস পালনের সিদ্ধান্ত নেন।


মাত্র ১৫ হাজার টাকায় শুরু, এখন লাখ টাকার স্বপ্ন

মাত্র ১৫ হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে অস্ট্রেলিয়ান জাতের ৫০০ হাঁসের বাচ্চা কিনে খামার শুরু করেন মিনারা বেগম। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র তিন মাসের লালন-পালনে প্রথম চালানে ১ লক্ষ ১১ হাজার টাকার হাঁস বিক্রি করেন। এতে খরচ বাদে মিনারা বেগমের লাভ হয় প্রায় ৬০ হাজার টাকা। বর্তমানে তার খামারে ১ হাজার ৬০০টি অস্ট্রেলিয়ান জাতের হাঁস রয়েছে। এবার তিনি হাঁস বিক্রি করে লক্ষাধিক টাকা লাভ করার আশা করছেন।

হাঁসের খামার তার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। তিনি সংসারের সব ঘাটতি পূরণ করেছেন, ঋণ পরিশোধ করেছেন এবং তাদের ছোট মেয়ে দাওরায়ে হাদিস পড়াশোনা শেষ করেছে।


খরচ সাশ্রয়ের অভিনব কৌশল ও চ্যালেঞ্জ

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পাশে নেট আর বেড়া দিয়ে ঘেরা খামারটিতে মিনারা বেগম নিজেই হাঁসদের খাবার দিচ্ছেন। তিনি জানান, প্রতি বছর এই মৌসুমেই তিনি হাঁস পালন করেন। সিরাজগঞ্জের একটি হ্যাচারি থেকে প্রতি পিস হাঁসের বাচ্চা ৩৬ টাকা দরে কেনেন। ব্যাংক বা বিকাশের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করলে হ্যাচারির মালিকরাই বাড়িতে বাচ্চা পৌঁছে দেন। সেই বাচ্চা ৩ থেকে ৪ মাস পালন করলেই বিক্রির উপযুক্ত হয়। প্রতি হাঁস ১৯০ থেকে ২৫০ টাকা দরে বিভিন্ন হ্যাচারির মালিকরাই তার কাছ থেকে কিনে নিয়ে যান।

হাঁস পালনে খরচ সাশ্রয়ে মিনারা এক অভিনব পথ বেছে নিয়েছেন। তিনি বলেন, “খামারে কেনা খাবার খাওয়ালে অনেক খরচ বেশি হতো। কিন্তু বাড়ির পাশে ইরি-বোরো ধান কাটার পর আমন ধান রোপণ করার আগ পর্যন্ত ফাঁকা মাঠে হাঁসগুলোকে ছেড়ে দিয়ে প্রাকৃতিক খাবার খাওয়াই, এজন্য খরচ কম হয়।”

তবে হাঁস পালনে ঝুঁকির কথাও জানান তিনি। জ্বর, সর্দি ও হাপানি রোগের কারণে হাঁসের সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং এতে হাঁস মারা যায়। সে ক্ষেত্রে ঔষধের খরচ বেশি হয়। বাড়ি দূরে হওয়ায় প্রাণীসম্পদ অফিসে নিয়মিত যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না।


ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা

মিনারা বেগম তার খামারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন, আগামীতে নিজ বাড়িতে বড় খামারের পাশাপাশি একটি হ্যাচারি করার চিন্তা রয়েছে।

অন্যদিকে, মিনারা বেগমের হাঁসের খামারের সাফল্য দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ওই গ্রামের নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি ৫০০ হাঁসের বাচ্চা দিয়ে পালন শুরু করেছেন। আগামীতে তিনিও খামারের পরিসর বাড়ানোর চিন্তা রয়েছে বলে জানান।

এ বিষয়ে উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ হাসান আলী বলেন, “উপজেলায় এখন অনেক হাঁসের খামারি আছেন। তারা উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর-এর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে আমাদের পরামর্শে হাঁস লালন-পালন করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন মিনারা খাতুন। আমরা সকলকে দ্রুততার সহিত সেবা প্রদান করে থাকি। টিকা, চিকিৎসা, বিভিন্ন ধরনের সরকারি সুযোগ সুবিধা আমরা খামারিদেরকে দিয়ে থাকি। এই খামারিরাই আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকা এবং ভবিষ্যতে আরও বড় অবদান রাখবে তারা।”

ট্যাগ :
লেখক সম্পর্কে তথ্য

জনপ্রিয়

আরএমও’র বিরুদ্ধে শৈলকুপা হাসপাতালে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ: চিকিৎসা সেবায় ব্যাঘাত

পাঁচবিবিতে হাঁস পালনে স্বাবলম্বী মিনারা বেগম: সফলতার নতুন দিশা!

আপডেট : ১১:৫১:৩৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫

জয়পুরহাট, ২৪ জুন ২০২৫: এক সময়ের অভাবী সংসারের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে নিজের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছেন পাঁচবিবি উপজেলার আওলাই ইউনিয়নের নওগাঁ কাঁঠালী গ্রামের গৃহিণী মিনারা বেগম। তিনি এখন একজন সফল উদ্যোক্তা, যিনি হাঁস পালন করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। তার এই প্রচেষ্টা দেখে এলাকার অনেকেই এখন বাড়তি আয়ের আশায় হাঁস পালনের কথা ভাবছেন।


অভাব থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প

মিনারা বেগমের স্বামী ফজলুর রহমান একজন প্রান্তিক কৃষক, যার জমিজমা খুব বেশি নয়। দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে তারা অত্যন্ত কষ্টে দিন কাটাচ্ছিলেন। সামান্য জমি চাষাবাদ আর কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে ইতোমধ্যে বড় মেয়ে ও ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে কওমী মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। ছেলেমেয়েদের বিয়ে ও ছোট মেয়ের পড়াশোনার খরচ যোগাতে গিয়ে তারা অনেকটাই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সংসারের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনৈতিকভাবে চরম সংকটে পড়ে যান মিনারা ও ফজলুর দম্পতি।

স্বামীর আয়ে সংসার চালানো দায় হয়ে পড়লে মিনারা বেগম আয় বাড়াতে বিকল্প চিন্তা করেন। সেই ভাবনা থেকে গত পাঁচ বছর আগে পার্শ্ববর্তী ঘোড়াঘাট উপজেলার বলাহার গ্রামের তার ভাইয়ের হাঁসের খামার দেখে হাঁস পালনের সিদ্ধান্ত নেন।


মাত্র ১৫ হাজার টাকায় শুরু, এখন লাখ টাকার স্বপ্ন

মাত্র ১৫ হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে অস্ট্রেলিয়ান জাতের ৫০০ হাঁসের বাচ্চা কিনে খামার শুরু করেন মিনারা বেগম। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র তিন মাসের লালন-পালনে প্রথম চালানে ১ লক্ষ ১১ হাজার টাকার হাঁস বিক্রি করেন। এতে খরচ বাদে মিনারা বেগমের লাভ হয় প্রায় ৬০ হাজার টাকা। বর্তমানে তার খামারে ১ হাজার ৬০০টি অস্ট্রেলিয়ান জাতের হাঁস রয়েছে। এবার তিনি হাঁস বিক্রি করে লক্ষাধিক টাকা লাভ করার আশা করছেন।

হাঁসের খামার তার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। তিনি সংসারের সব ঘাটতি পূরণ করেছেন, ঋণ পরিশোধ করেছেন এবং তাদের ছোট মেয়ে দাওরায়ে হাদিস পড়াশোনা শেষ করেছে।


খরচ সাশ্রয়ের অভিনব কৌশল ও চ্যালেঞ্জ

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পাশে নেট আর বেড়া দিয়ে ঘেরা খামারটিতে মিনারা বেগম নিজেই হাঁসদের খাবার দিচ্ছেন। তিনি জানান, প্রতি বছর এই মৌসুমেই তিনি হাঁস পালন করেন। সিরাজগঞ্জের একটি হ্যাচারি থেকে প্রতি পিস হাঁসের বাচ্চা ৩৬ টাকা দরে কেনেন। ব্যাংক বা বিকাশের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করলে হ্যাচারির মালিকরাই বাড়িতে বাচ্চা পৌঁছে দেন। সেই বাচ্চা ৩ থেকে ৪ মাস পালন করলেই বিক্রির উপযুক্ত হয়। প্রতি হাঁস ১৯০ থেকে ২৫০ টাকা দরে বিভিন্ন হ্যাচারির মালিকরাই তার কাছ থেকে কিনে নিয়ে যান।

হাঁস পালনে খরচ সাশ্রয়ে মিনারা এক অভিনব পথ বেছে নিয়েছেন। তিনি বলেন, “খামারে কেনা খাবার খাওয়ালে অনেক খরচ বেশি হতো। কিন্তু বাড়ির পাশে ইরি-বোরো ধান কাটার পর আমন ধান রোপণ করার আগ পর্যন্ত ফাঁকা মাঠে হাঁসগুলোকে ছেড়ে দিয়ে প্রাকৃতিক খাবার খাওয়াই, এজন্য খরচ কম হয়।”

তবে হাঁস পালনে ঝুঁকির কথাও জানান তিনি। জ্বর, সর্দি ও হাপানি রোগের কারণে হাঁসের সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং এতে হাঁস মারা যায়। সে ক্ষেত্রে ঔষধের খরচ বেশি হয়। বাড়ি দূরে হওয়ায় প্রাণীসম্পদ অফিসে নিয়মিত যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না।


ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা

মিনারা বেগম তার খামারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন, আগামীতে নিজ বাড়িতে বড় খামারের পাশাপাশি একটি হ্যাচারি করার চিন্তা রয়েছে।

অন্যদিকে, মিনারা বেগমের হাঁসের খামারের সাফল্য দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ওই গ্রামের নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি ৫০০ হাঁসের বাচ্চা দিয়ে পালন শুরু করেছেন। আগামীতে তিনিও খামারের পরিসর বাড়ানোর চিন্তা রয়েছে বলে জানান।

এ বিষয়ে উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ হাসান আলী বলেন, “উপজেলায় এখন অনেক হাঁসের খামারি আছেন। তারা উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর-এর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে আমাদের পরামর্শে হাঁস লালন-পালন করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন মিনারা খাতুন। আমরা সকলকে দ্রুততার সহিত সেবা প্রদান করে থাকি। টিকা, চিকিৎসা, বিভিন্ন ধরনের সরকারি সুযোগ সুবিধা আমরা খামারিদেরকে দিয়ে থাকি। এই খামারিরাই আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকা এবং ভবিষ্যতে আরও বড় অবদান রাখবে তারা।”