জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ভারতের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেছে। তাদের অভিযোগ, ভারতীয় নৌবাহিনী নারী ও শিশুসহ কমপক্ষে ৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আন্দামান সাগরে ফেলে দিয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার (ওএইচসিএইচআর), রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পরিবার এবং তাদের আইনজীবীরা এই অভিযোগ করেছেন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ওই ৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে জীবন রক্ষাকারী জ্যাকেট পরিয়ে মিয়ানমারের সমুদ্রসীমার কাছে (আন্দামান সাগরে) ফেলে দেওয়া হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার (১৫ মে ২০২৫) এক বিবৃতিতে ওএইচসিএইচআর এই তথ্য জানায়। সংস্থাটি আরও উল্লেখ করে, গত ৬ মে নয়াদিল্লি থেকে আটক করা রোহিঙ্গাদের ভারতীয় নৌবাহিনীর কর্তৃপক্ষ ৮ মে বিমানযোগে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে নিয়ে যায় এবং এরপর তাদের একটি নৌবাহিনীর জাহাজে করে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়। ফেলে দেওয়া শরণার্থীদের মধ্যে শিশু, নারী ও বৃদ্ধরাও ছিলেন। সাঁতরে তারা মিয়ানমারের কোনো দ্বীপে পৌঁছাতে সক্ষম হলেও, তাদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে এখনো কিছু জানা যায়নি।
ভারতের শরণার্থীবিষয়ক কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে অভিযোগ করা হয়েছে, ফেরত আসা শরণার্থীদের অধিকাংশই ভারতে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) নিবন্ধিত ছিলেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহের অজুহাতে আটক করেছিল বলে অভিযোগ উঠেছে।
এই ঘটনায় জাতিসংঘ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করেছে। পাশাপাশি, ওএইচসিএইচআর ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, যেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এমন অমানবিক ও জীবনহানিকর পরিস্থিতিতে ঠেলে দেওয়া বন্ধ করা হয়।
জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক টম অ্যান্ড্রুজ এই ঘটনাকে আন্তর্জাতিক সুরক্ষা পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের প্রতি সরাসরি অবজ্ঞা এবং মানবতার বিরুদ্ধে এক নির্মম আচরণ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, এটি আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম মৌলিক নীতি ‘নন-রিফিউলমেন্ট’-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যেখানে কোনো ব্যক্তিকে এমন কোনো স্থানে ফেরত পাঠানো যায় না যেখানে তাদের জীবন বা স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)-কে পাঁচজন রোহিঙ্গা শরণার্থী জানিয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা এই অভিযানে ভুক্তভোগী। তাদের দাবি, ১৫ জন খ্রিস্টানসহ রোহিঙ্গাদের ওই দলটিকে প্রথমে প্লেনে করে পোর্ট ব্লেয়ারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে ভারতীয় নৌবাহিনীর সদস্যরা তাদের সাগরে ফেলে দেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোহিঙ্গা শরণার্থী জানান, তার ভাই ৮ মে স্থানীয় এক জেলের কাছ থেকে মোবাইল ধার করে ফোন করে জানিয়েছিল, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রথমে তাদের বাঁধা চোখ ও হাত খুলে দেয়। এরপর জীবন রক্ষাকারী জ্যাকেট পরিয়ে মিয়ানমারের জলসীমায় একটি দ্বীপের দিকে সাঁতরে যেতে বাধ্য করে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমার বাবা-মাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আমি শুধু আমার বাবা-মাকে ফিরে পেতে চাই। আমার আর কিছু লাগবে না।’
মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বাধীন সরকারের মুখপাত্র থেট সোয়ে তাৎক্ষণিকভাবে এই অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। এপি তাদের একটি ফোনালাপের রেকর্ডও পর্যালোচনা করেছে, যেখানে এক রোহিঙ্গা তার ভাইকে ফোনে জানাচ্ছেন, গ্রুপের কয়েকজন সদস্যকে ভারতীয় নৌবাহিনীর সদস্যরা মারধর করেছে। ভারতের নৌবাহিনী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। ভারতের বিরুদ্ধে এই গুরুতর অভিযোগগুলো বিশ্বজুড়ে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
ভারত এখনো শরণার্থীদের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট জাতীয় নীতি বা আইন প্রণয়ন করেনি এবং ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন ও ১৯৬৭ সালের প্রটোকলের সদস্যও নয়। তা সত্ত্বেও, দেশটিতে আনুমানিক ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছেন, যাদের মধ্যে ২২ হাজার ৫০০ জন ইউএনএইচসিআর-এর নিবন্ধিত সদস্য। তারা মূলত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অনুন্নত ও অস্বাস্থ্যকর ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এবং দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোর বিদ্বেষের শিকার। অনেক রোহিঙ্গাকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আটক করে ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হয়েছে এবং কিছু রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে ফেরতও পাঠানো হয়েছে।
২০২৩ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) কার্যকর করে, যা সমালোচকদের মতে মুসলিম শরণার্থী, বিশেষত রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈষম্যমূলক। এই পরিস্থিতিতে, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে ভারত সরকারের প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবাধিকার রক্ষার জোর দাবি জানানো হয়েছে এবং এই অমানবিক ঘটনার দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছে।